New page

From WikiEducator
Jump to: navigation, search

ইতিহাসের পম্পেই নগরী
সাগরের উত্তাল করাল গ্রাসে হারিয়ে যাওয়া নোয়াখালী পুরাতন শহর

মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

নোয়াখালী শহরের খোঁজে

আপনি যদি খুব আগ্রহ ভরে নোয়াখালী আসতে চান তাহলে আপনাকে নামতে হবে মাইজদী কোর্টে। নোয়াখালীর বিকল্প শহর হিসাবে এটি গড়ে উঠেছে ১৯৫০ সালের দিকে। সুন্দর ছিমছাম নিরিবিলি শহর। চমত্কার পরিবেশ। শান্তির শহর হিসাবেও এর সুখ্যাতি আছে প্রচুর। না শহর না গ্রাম এমন পরিবেশে ইত:স্তত ঘুরতে ঘুরতে স্নিগ্ধতায় ভরে যাবে আপনার মন। আপনি যদি মূল নোয়াখালী খুঁজতে চান তো এখানে পাবেননা। আপনাকে যেতে হবে আরো পাঁচ ছয় কিলোমিটার দক্ষিণে। রিক্সা কিংবা বাস টেম্পুতে চড়ে নির্মল বাতাস খেতে খেতে চলে আসুন সোনাপুরে। না এখানেও নোয়াখালী খুঁজে পাবেননা। তবে সোনাপুর রেল ষ্টেশানের নাম ফলকে দেখা পাবেন ‘নোয়াখালী’ লেখা। জায়গাটি সোনাপুর, রেল ষ্টেশানের নাম নোয়াখালী। আপনি নিশ্চই বিভ্রান্তের মধ্যে পড়বেন। এখানে শেষ হয়ে গেছে রেলের সমান্তরাল লাইন। না ঠিক শেষ নয়, যেন থমকে গেছে। শুধু তো নাম ফলকই নোয়াখালী নয়। আপনি খুঁজতে থাকুন উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে চতুর্দিকে। ক’কদম সামনে রাস্তা। পূর্ব পশ্চিমে পাকা। আসলে ঠিক রাস্তা নয়। এটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়ি বাঁধ। সোনাপুর নতুন বাজার চিরে পূর্ব পশ্চিমে বিস্তৃত। দক্ষিন-পশ্চিমে রাস্তাটি ঘুরে চলে গেছে চর জব্বর, রামগতি। পূর্বে গেছে কবির হাট উপজেলায়। সোজা দক্ষিনে আর একটি রাস্তা চলে গেছে প্রায় ষাট কিলোমিটার দূরে হাতিয়া ষ্টিমার ঘাটে। কাউকে যদি আপনি জিজ্ঞেস করেন নোয়াখালী শহরের কথা। অবাক বিস্ময়ে আপনার দিকে তাকিয়ে আরো দক্ষিনে আঙুল দিয়ে দেখাবে। কিন্তু তার চেয়ে বেশী বিস্মিত হবেন আপনি নিজেই। শত বছরের কোলাহলময় কর্মচঞ্চলতায় ভরা কোথায় সে শহর! ততক্ষনে দক্ষিনের দূর সমুদ্র থেকে হয়তো আরো এক ঝাপটা লোনা বাতাস আপনাকে আরো আবিষ্ট করে ফেলবে। ইতিমধ্যে আপনি হয়তো খুব বৃদ্ধ কাউকে পেয়েও যাবেন। যিনি আপনাকে নিয়ে যাবেন সেই স্বপ্নময় এক অতীতে। সত্তর আশি বছর আগে তার শৈশব কিংবা যৌবনের সেই সব সোনালি দিনের কাছে। আপনি যদি তাঁর স্মৃতিতে আঁচড় দিয়ে বস করতে পারেন, তাহলে তাঁর স্মৃতির পঙ্খীরাজে চড়িয়ে আপনাকেও নিয়ে যাবে নিকট অতীতের এক স্বপ্নময় শহরে। যে শহর ছিলো সমুদ্র উপকূলবর্তী এক অনিন্দ্যসুন্দর প্রকৃতির প্রাচুর্যে ভরা হাজার বছরের সমৃদ্ধশালী নোয়াখালী শহর।

আমরা পৃথিবীর সমৃদ্ধশালী সভ্যতার দিকে তাকালে দেখতে পাই, সে সভ্যতা গড়ে উঠেছিলো কোনো নদী কিংবা সমুদ্রতীরে। নোয়াখালীর ভৌগোলিক অবস্থানই একটি সমৃদ্ধশালী জনপদ গড়ে উঠার জন্য যথেস্ট অনুকূলে ছিলো। হাজার বছর ধরে তিল তিল করে গড়েও উঠেছিলো। প্রাচীন কাব্যে নানা ভাবে নোয়াখালীর স্তুতি নিয়ে নানান স্লোক গাঁথা হয়েছে।


পূর্ব দিকে চট্টগ্রাম ত্রিপুরা পাহাড়
পশ্চিমে মেঘনা নদী ভীষম আকার
উত্তরে ত্রিপুরা জেলা দক্ষিনে সাগর
মধ্যে শোভে নোয়াখালী কিবা মনোহর


এই মনোহর শহর একদিনে গড়ে উঠেনি। সুদূর অতীত কালেও চির হরিতের দেশ ছিলো এই সমুদ্র-মেখলা নোয়াখালী। বিশাল সমতল প্রান্তর ছিলো এই অঞ্চল। মধ্য যুগের কবিরা সেই প্রান্তরকে তুলনা করতেন স্বর্গের মস্রিন সবুজ গালিচার মতন। প্রথিতযশা সাংবাদিক সানাউল্লা নূরী এ অঞ্চল নিয়ে গবেষনা ধর্মী লেখায় বর্ণনা করলেন, ‘আবহমান কাল থেকেই এই মাটির বুকে জুড়ে ছিলো কনকচূড় ধানের স্বর্ণালী সমারোহ। ছায়া ঢাকা পাখি ডাকা গ্রাম গুলি ছিলো তাল তমাল আর নারিকেল সুপারি কুঞ্জ খচিত একেকটি আদিগন্ত অরণ্য। সাগরের ললাটে কাঁচ-টিপের মত শোভা পেতো এই ভূ-খন্ডের ফসল সম্ভারে ভরা শ্যামল দ্বীপ মালা। সপ্তম শতকে এই উপকূলের দেশের সমৃদ্ধি বর্ণাঢ্য নৈসর্গিক সৌন্দর্য আর জনগনের সুখময় জীবনের রূপ দেখে বিস্ময় বিমূঢ় হয়েছিলেন চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন-সাঙ। সাত শ’ বছর পরে চতুর্দশ শতকে এই উপকূলীয় দেশ হয়ে দূর প্রাচ্য সফরে গিয়েছিলেন প্রখ্যাত আরব পর্যটক ইবনে বতুতা। মহান এই পরিব্রাজক আফ্রিকা মধ্যপ্রাচ্য মধ্য এশিয়া প্রাচীন ভারত দক্ষিন-পূর্ব এশিয়া এবং দূর প্রাচ্যের বহু দেশ আর জনপদ ভ্রমন করেছেন। কিন্তু বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী এই ভূখন্ডের মত আর কোনো অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সম্পদ সমারোহ তার মনে অমন গভীর ভাবে রেখাপাত করতে পারেনি’।

নোয়াখালীর আদি নাম ছিলো ‘ভুলুয়া’। নানা ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায় ভুলুয়া ছিলো বঙ্গপসাগর তীরবর্তী অঞ্চলের প্রাচীনতম ইতিহাসের স্নায়ু কেন্দ্র। এটি ছিলো একসময়ের বর্ধিষ্ণু সামুদ্রিক বন্দর। কিংবন্তিতে বঙ্গোপসাগরকে ক্ষীরদ সাগর বা ক্ষীর সাগর বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। খৃষ্টের জন্মের বহু পূর্ব থেকেই ভূলুয়া বন্দর ছিলো প্রাচীন পৃথিবীর একটি আন্তর্জাতিক আত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নৌ-বানিজ্য বন্দর। এই বন্দরের সাথে সরাসরি যোগাযোগ ছিলো মিসর, লবানন, জাঞ্জিবার, বসরা, শ্রীলঙ্কা, তাম্রলিপি, সুমাত্রা, জাভা প্রভৃতি সমুদ্র বন্দরের সাথে। আসাম আরাকান সহ দূর প্রাচ্যের সাথে ছিলো এর ঘনিষ্ট যোগাযোগ।

সুপ্রাচীন কাল থেকে যোগাযোগের কারনে এ অঞ্চলে একটি স্বাতন্ত্র সভ্যতার সৃষ্টি হয়। ভাষা সংস্কৃতি কৃষ্টিতে ছিলো পৃথিবীর নানান জাতীর একটি মিশ্র সংস্কৃতি। গড়ে উঠেছিলো একটি উন্নত নগর। পরবর্তীতে যা হয়ে উঠেছিলো ঐতিহ্যবাহি ঐতিহাসিক নগরীতে। ধীরে ধীরে গড়ে উঠে পর্তুগীজ, স্পেনীয়, ইংরেজ ও আরবীয় স্থাপত্যের বহু ইমারত ও ভবন। নোয়াখালী টাউন হল ছিলো জার্মান গ্রীক ও রোম সভ্যতার মিশ্রনে অপূর্ব স্থাপত্যকলার নিদর্শন। একটি সুপরিকল্পিত নগর হিসাবে গড়ে উঠে সমগ্র শহর। ছিলো ঘোড়দৌড়ের মাঠ। ছিলো কালেক্টরেট ভবন, জর্জকোর্ট, পুলিশ লাইন, জেলখানা, হাসপাতাল, মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, স্কুল, মাদ্রাসা। ছিলো সুপ্রসস্ত রাস্তা। শহরে যান বাহনের মধ্যে ছিলো মূলত: ঘোড়ার গাড়ি। সুপ্রস্ত রাস্তার দুধারে ছিলো নয়নাভিরাম ঝাউ বীথিকা। সারা নগর জুড়ে ছিলো নানা ফল আর সুবৃহৎ বৃক্ষের সাজানো স্বর্গীয় বাগানের মত উদ্যান। না, সে অনিন্দ্য সুন্দর নগরীর সামান্যতমও আপনি এখন আর দেখতে পাবেন না। খুঁজে পাবেন না কোনো ধংসাবশেষের চিহ্ন। যা প্রত্নতাত্বিকদের মনোবাঞ্ছনা পূরণ করেত পারে। দৈব দুর্যোগে পম্পেই নগরী ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো আজ থেকে প্রায় দু’হাজার বছর আগে। সব কিছু ধ্বংস হলেও কিছুটা চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো যার সূত্র ধরে প্রত্নতাত্বিকরা খুঁজে পেল অতীত সভ্যতার ইতিহাস। মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা, ব্যাবিলন, ক্যালাডিয়া, মেম্পিস, প্রভৃতি নগরী ইতিহাসের বিস্মৃতির অধ্যায় থেকে ফের উঁকি দেয় সেখানে কুড়িয়ে পাওয়া চিহ্ন গুলোর রেশ ধরে ধরে। বেড়ি বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে দক্ষিনে তাকিয়ে দেখুন। আদিগন্ত সবুজের সমারোহ। ছোট ছোট খড়ের ঘর। ঘর গুলোকে ঘিরে আছে নানান ছায়া বৃক্ষ। আপনি একে একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম বলেই ভ্রম করবেন। এই এখানেই ছিলো এক সময়ের কোলাহলময় ছিমছাম নোয়াখালী শহর। এখন তার কিছুই বুঝার উপায় নেই। প্রায় হাজার বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে উঠা তিলোত্তমা এই নগরী প্রায় দু’শ বছর ধরে ভাঙ্গা গড়ার খেলা খেলেখেলে শেষ বারে যেন হঠাৎই একেবারে এক ঝাপটায় চিরতরে হারিয়ে গেলো। নোয়খালী শহর যখন ভাঙ্গনের শেষ প্রান্তে তখন চলছিলো বিশ্বযুদ্ধ। ইতিহাসের এক বিশেষ ক্রান্তিকাল। বৃটিশ সাম্রাজ্যের টিকে থাকার মরণপন লড়াই। প্রতি মুহুর্তে জাপানী বোমার আতঙ্ক। উপমহাদেশে চলছিলো বৃটিশ বিরোধী রক্তক্ষয়ী আন্দোলন। নেতাজী সুভাষ বসুর আজাদহিন্দ ফৌজের সশস্ত্র লড়াই। স্বদেশী আন্দোলন। নোয়াখালীর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। গান্ধিজীর অহিংস আন্দোলন। বাজছিলো বৃটিশ বিউগিলের শেষ করুণ নিনাদ। রাজনীতি আর প্রকৃতির ভাঙ্গাগড়ার এক অভুতপূর্ব মিশ্রন। সেই সাথে মিশেল হলো দক্ষিণ-পূর্ববাংলার সমুদ্রোপকূলীয় সাহসী লোনা মানুষদের ভিটে মাটি রক্ষার এক প্রাণপণ লড়াই। মাত্র ষাট সত্তর বছর আগে শেষ চিহ্ন টুকুও হারিয়ে গেলো। তখনও বিজ্ঞান প্রযুক্তি প্রায় সবই ছিলো। হয়তো একটু শেষ চেষ্টা করলে কিছুটা রক্ষা পেতো কিন্তু তখনকার বৃটিশ শাসকদের সীমাহীন ঔদাসিন্য আর অবহেলায় চির অভিমানি সাগর পাড়ের রূপসী জলকন্যা সাগরেই বিসর্জন দিলো নিজেকে। সে সময এলাকার মানুষরা নিজেরা নিজেদের মত করে স্বেচ্ছাশ্রমে শেষ চেস্টা করেছিলো। সাগরকে রুখতে চেয়েছিলো তারা। সাগরের মধ্যে বাঁধ দিয়ে ভাঙ্গন ঠেকাতে চেয়েছিলো। কিছুটা সফলকাম হয়েওছিলো। সেটি এখন ওবায়দুল্লা ইঞ্জিনিয়র বাঁধ নামে এলাকার মানুষের মুখে মুখে কিংবদন্তি হয়ে আছে। কিন্তু শেষ রক্ষাটি আর হয়নি। সোনাপুর বাজারের পাশে যে বেড়ি বাঁধে আপনি দাঁড়িয়েছেন, ঠিক সেখান ১৯৭০ সনের ১২ নভেম্বরের গর্কিতে শত শত লাশ ভেসে এসেছিলো। এই সেদিনও সাগরের উত্তাল ঢেউ এসে আছাড় খেত এখানে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কালেও নিত্য জোয়ার ভাটা হতো এখানে। ধীরে ধীরে এখানে গড়ে উঠলো বাজার। সোনাপুর বাজারের মধ্যদিয়ে প্রায় চার কিলোমিটার দক্ষিণে গেলে ডানে পড়বে প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। একেবারে নতুন চরে নতুন ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এটি। তার আগে পুরাতন শহরের কিছু দেখতে চান তো বাজার থেকে একটু দক্ষিণে গেলে ডানে পড়বে মন্তিয়ার ঘোনা। শহরের গন্যমান্য ব্যক্তিদের এখানে ছিলো বাসস্থান। নতুন পাকা রাস্তা ধরে এগুলে পড়বে ইনকাম চৌধুরীর পোল। তারপর ঠ্ক্কর। জ্বী হ্যাঁ, জায়গাটির নাম ঠক্কর। নতুন বসতির নতুন মানুষেরা এই স্থানগুলোর এ রকম নাম দিয়েছে। যেমন আইন্নালাসা, আলু ওয়ালার দোকান, গুইল গুইল্লা বাজার ইত্যাদি। কি ভাবে এ রকম কিম্ভুত নাম হলো তার কাহিনীগুলোও খুব মজার।

ঘুরতে ঘুরতে আপনি প্রবীন কাউকে পেয়েও যাবেন। তিনি আপনাকে তাঁর স্মৃতি হাতড়ে আঙ্গুল দিয়ে দেখাবেন, ‘ঐ বড় মসজিদ, গীর্জা, ঐ কোর্ট বিল্ডিং, ঐতো জেলখানা, পুলিশ লাইন। আর দূরে দিগন্তে আঙ্গুল দিয়ে দেখাবেন, ‘ঐ যে ঘোড় দৌড়ের মাঠ’। আপনি বিস্ময়ে ভাবুন, কিরকম ঐতিহ্যের শহর ছিলো, যেখানে নিয়মিত ঘোড়দৌড় হোতো। তিনি আরো বলবেন, ‘এই যে এখানে ছিলো চল্লিশ ফুট প্রশস্ত সদর রাস্তা। বাস্তবে নয়, আপনি চোখ বুজে সব কলাপনায় দেখে নেবেন। ‘এই যে এখানে, সল্লাঘটিয়া, মল্লাসটাইয়ার মোড়, নাগপাড়া, বকুলতলা, দেবালয়, মন্দির’। ঘোড়দৌড়ের বিশাল চত্বরে আপনি হয়তো কান পেতে এখনো শুনতে পাবেন, উদ্দাম বেগে ছুটে চলা সেই পেশী বহুল ঘোড় সওয়ারের ছুটন্ত অশ্বখুরের শব্দ। কল্পনায় আপনি অনুভব করবেন। আর কল্পনার জগত্ ছেড়ে সত্যি সত্যি আপনি বাস্তবে দেখতে পাবেন, সেই বৃদ্ধের দুই উদাস করা চোখের কোনে চিক চিক করে সমুদ্রের লোনা জল ঝলক দিয়ে উঠছে। আর বুক চিরে উতরে উঠছে এক দীর্ঘশ্বাস, যেন বহু দূর সমুদ্রের কান্না জড়িত হুহু করে ধেয়ে আসা বিষন্ন বাতাস। চাপা কান্নায় কষ্টের বেহাগ সুরে তিনি আপনাকে শুনাবেন তাঁর হারিয়ে যাওয়া শহরের কাহিনী।

জীবন জীবিকা

সাগর পাড়ের বসতি হওয়ায় এই এলাকার মানুষের জীবিকা ছিলো মূলত: মত্স্য চাষ। নদী বন্দরের কারনে এখানে বাস করেতেন অনেক বনেদি ব্যাবসায়ী। আর উর্বর সমতল ভূমির কারনে বিপুল জনগোষ্ঠী ছিলো কৃষিজীবী। সুদূর অতীত কাল থেকে বিক্ষুব্ধ সাগর বারবার আঘাত হেনেছে এ অঞ্চলে। মানুষজনও সে সাগরকে সাহসীকতায় রুখেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। সে কারনে এ অঞ্চলের মানুষ প্রকৃতিগত ভাবেই হয়ে উঠেছে সাহসী স্বাধীনচেতা পরিশ্রমী আর একরোখা। সমতল ভূমি যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে শুরু হয়েছে বিশাল নীলজলরাসীর উদার সমুদ্র। তাই স্বভাবেও এ এলাকার মানুষ হয়েছে সমুদ্রের মত উদার প্রকৃতির। হয়েছে বন্ধুবৎসল আর অতিথিপরায়ন।

শত শত বছর ধরে এ অঞ্চলের মানুষ গিয়েছে ভিন্ন অঞ্চলে আবার ভিন্ন অঞ্চলের মানুষেরা এসেছে এ অঞ্চলে। সৃষ্টি হয়েছে এক মিশ্র স্বাতন্ত্র সংস্কৃতির। ভাষা সংস্কৃতিতে যা বাংলাদেশের অন্য অঞ্চল থেকে ভিন্ন। স্থানীয় ভাষার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে ইংরেজী জার্মান পর্তুগীজ আরাকানী আর আরবীয় ভাষার ছড়াছড়ি সহ নানান ভাষার মিশ্রন। নানা দেশের নানা জ্ঞানী গুনী শিক্ষিত মানুষের সংস্পর্শে এসে এ এলাকার মানুষের মধ্যে জেগেছে শিক্ষার স্পৃহা। এ এলাকার বিপুল জনগোষ্ঠী ছিলো বেশ শিক্ষত। শিক্ষিতের হার বেশী বলে এখনো দেশে ও বিদেশে এর সুখ্যাতি রয়েছে। এক বিরাট অংশ ছিলো বনেদি ব্যবসায়ী। ধান চাল কাপড় কাঠ লবন আর মসল্লা ছিলো মূলত: প্রধান পন্য।

বর্তমান প্রেক্ষিত

একটি মৌচাকে ঢিল ছুঁড়লে যেমন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সবাই ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ছুটাছুটি করে, তেমনি শহরের শেষ চিহ্ন মুছে যাবার সাথে সাথে সহায় সম্বলহীন মানুষ যে যেদিকে পেরেছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিলো চতুর্দিকে। কেউ আস্তানা গাঁড়লেন মাইজদী সোনাপুরে, কেউ ঢাকা চট্টগ্রাম সহ দেশের বিস্তীর্ন অঞ্চলে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, উপমহাদেশ জুড়ে রাজনৈতিক ভাঙ্গাগড়ার নতুন মেরুকরণ, দেশ বিভাগ সবই এক সাথে চলছিলো তখন। এক বিরাট অংশ চলে গেলো পশ্চিম বঙ্গে। সৃষ্টি হোলো বিরাট শূন্যতা।

সে শহরে ছিলো অনেক গুলো নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। রায়বাহাদুর রাজকুমার জিলা স্কুল বা আর, কে, জিলা স্কুল, বঙ্গবিদ্যালয়, আহমদীয়া হাই স্কুল, অরুণ চন্দ্র বিদ্যালয়, হরিনারায়ন হাই স্কুল, কল্যান চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়, উমা চরণ গার্লস হাই স্কুল, ব্রাদার আঁন্দ্রেজ হাইস্কুল, কেরামতিয় আলিয়া মাদ্রাসা ইত্যাদি। সেগুলো টিনের ছাউনি দিয়ে ছাপড়ার মত করে স্থানান্তরিক হোলো সোনাপুর, মাইজদীতে। সেখানে শিক্ষক নেই ছাত্র নেই। এক সময়ের উপমহাদেশ খ্যাত বিদ্যাপিট গুলো হয়ে পড়লো নীরব নিথর শূন্যতায় ভরা।

এ সময় নতুন শহর মাইজদীতে স্থানান্তরিত হোলো কোর্ট কাছারি সরকারী দপ্তর অফিস। বৃটিশ শাসনের শেষ সময়টিতে মাইজদীতে একটি বড় দীঘি কেটে তার চতুর্দিকে করা হোলা সড়ক। বাংলো প্যাটার্নের টিনের শেড করে তৈরি হোলো অফিস আদালত। মাইজদীর যে অংশে কোর্ট কাছারি বসলো তার ভিণ্ণ নাম হোলো মাইজদী কোর্ট। শহরের পশ্চিম অংশ দিয়ে চলে গেছে প্রধান সডক। আর প্রায় দেড় কিলোমিটার পূর্বদিক দিয়ে গেছে নোয়াখালী-লাকসাম রেল লাইন। শহরের উত্তর পূর্বদিকে আগেই ছিলো মাইজদী রেল ষ্টেশান তার প্রায় তিন কিলোমিটার দক্ষিনে একটি নতুন রেল ষ্টেশান স্থাপিত হোলো মাইজদী কোর্ট রেল ষ্টেশান। সে সময় শহরটি স্থানান্তরিত হওয়ার সময় হারিয়ে গেছে অনেক মূল্যবান দলিল দস্তাবেজ।

এক সময় যত দ্রুত শহর ভাঙলো তার চেয়ে যেন দ্রুত উঠতে থাকে নতুন চর। সৃষ্টি হয় আগ্রাসী চর দখলকারী গোষ্ঠির। গড়ে উঠে সেটেলম্যান্টের ভূয়া দলিল আর কাগজ তৈরির এক লোভী সুযোগসন্ধানী চক্র। এক বিপুল সরকারী ও নানা মানুষের জায়গা জমি দখল করে নেয় কুটবুদ্ধি সম্পন্ন দখলদারী গোষ্ঠী। নতুন চরে চরে হামলে পড়লো দুর্ধর্ষ লাঠিয়াল বাহিনী। চর দখল নিয়ে শুরু হোলো রক্তারক্তি হানাহানি। নতুন চরের লোনা মাটি আর মানুষের তাজা লোনা রক্ত ফিনকি দিয়ে মিশে একাকার হোলো। মৌরসী জমি ফিরে পেতে আপ্রাণ চেষ্টা করলেন অনেকে। কেউ কেউ আবার ফিরে পেতে এসেছেন তার জমি। কেউ উদ্ধার করতে পেরেছেন। কেউ পারেননি। যারা উদ্ধার করতে পারেনি আদালতের আশ্রয় নিয়েছেন তাঁরা। এখনও শত শত মামলা বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন পড়ে আছে।

নাড়ির টান

যে কোনো মানুষের স্বভাবে রয়েছে তার উতসের দিকে তার মূলের দিকে নিবিড় স্পর্শ কাতরতা। প্রকৃতিগত এক সহজাত প্রবৃত্তি। আর এই সহজাত স্বহজাত স্বভাবের জন্য হাজার হাজার মাইল দূরে তার উতসের দিকে নাড়ির টান অনুভব করে। শত বাধা বিপত্তি ডিঙিয়ে সে যেতে চায় তার উতসের গভীর মূলে। যারা এক সময় বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছিলো তাদের কেউ কেউ আবার ফিরে এসেছে এই এলাকায়। ধীরে ধীরে নির্মিত হচাছে রাস্তাঘাট।যোগাযোগ হয়েছে সহজ। কেউ গড়ে তুলেছেন নানা কৃষি খামার। কেউ বাড়িঘর। গড়ে উঠছে হাউজিং প্রকল্প। কেউ জমিতে করছেন চাষাবাদ।একটু একটু আবাদি হয়ে উঠেছে সমগ্র এলাকা।গড়ে উঠছে স্কুল, মক্তব, মাদ্রাসা, মসজিদ বাজার। এ এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশাল এলাকা জুড়ে এর অবস্থান। পাশেই গড়ে উঠছে শিল্প এলাকা। ধীরে ধীরে আবার সৃষ্টি হবে নতুন এক সভ্যতার। নোয়াখালী ইউনিয়ন

যে নোয়াখালী নিয়ে এত এত গবেষণা লেখালেখি। সেই নোয়াখালী নামে এখন আছে স্থানীয় সরকারের অধীনে একটি ইউনিয়ন। নদীতে ভেঙ্গে যাওয়া নোয়াখালী শহর আবার জেগে উঠলে সেটি এখন একটি ইউনিয়ন হিসাবে পরিগনিত হচ্ছে। সেই ঐতিহাসিক শহর নগরী এখন নিভৃত একটি ইউনিয়ন পরিষদ মাত্র। বৈচিত্রময় ভাষার মাহাত্ম্য ছাড়া যার আর কিছুই নেই। কিছু নেই।

মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ