‘আমাদের রাজনীতির পুরো সিস্টেমটাই ত্রুটিপূর্ণ’

From WikiEducator
Jump to: navigation, search

‘আমাদের রাজনীতির পুরো সিস্টেমটাই ত্রুটিপূর্ণ’

আ স ম আব্দুর রব।

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এর উপদেষ্টা, সাবেক মন্ত্রী। তিনি সম্প্রতি নোয়াখালীর চরবাটা স্টীমার ঘাটে এলে নোয়াখালীর উন্নয়ন, বন উজাড়, রাজনীতি ও ভূমিহীন সমস্যাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন। লোক সংবাদ-এর পক্ষ থেকে তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ''মাহমুদুল হক ফয়েজ

।লোক সংবাদ : আপনি স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন অন্যতম সংগঠক। নোয়াখালীর সন্তান। এলাকার ছেলে হিসেবে খেটে খাওয়া মানুষের জীবনে রাজনীতির কী প্রভাব রয়েছে বলে মনে করেন।
আ স ম রব : আমার তো আসলে কোনো জ্ঞান নেই। জ্ঞান বুদ্ধি আছে তাদের যারা ক্ষমতায় আছে। ওদের জ্ঞান, বুদ্ধি, মেধা, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা সবই আছে। তারা বঙ্গভবন থেকে প্রধানমন্ত্রীর ভবন, রাষ্ট্রপতির ভবন, মন্ত্রী, এমপি, পার্লামেন্ট সব কিনতে পারে। টাকা সমাজের সমস্ত কিছুকে গ্রাস করেছে। এটা আমাদের হাজার বছরের ইতিহাসকে, ঐতিহ্য সংস্কৃতি কৃষ্টিকে ধ্বংস করে ফেলছে। ফেনসিডিল দিয়ে খুব পরিকল্পিতভাবে যুবক শ্রেণীকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমাদের এখানে পলিটিক্যাল পার্টি মাস্তান পোষে। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। তারা ফেনসিডিল কেনার জন্য, অস্ত্র কেনার জন্য টাকা দেয়। তারা চাঁদাবাজি করায়, চর দখল করায়, ডি-ফরেস্টেশনের জন্য টাকা দেয়। এখন পুলিশ আওয়ামী লীগের পুলিশ বিএনপির পুলিশ। আওয়ামী লীগের কোর্ট, বিএনপির কোর্ট, যে আদালতে বিএনপির জজ- সে আদালতে বিএনপির মামলা-যে আদালতে আওয়ামী লীগের জজ- সে আদালতে আওয়ামী লীগের মামলা, যে আদালতে জাসদের জজ, সে আদালতে জাসদের মামলা। মন্ত্রীরা দুর্নীতির মামলার জন্য সরকারের কাছে দর কষাকষি করে। আমাদের বিরুদ্ধে বিগত আমলে যে মামলা হয়েছে, আমরা যে চুরি-টুরি করছি সেগুলো ‘স্টপ’ না হলে আমরা পার্লামেন্টে যাব না। কিন্তু আমার কথা হলো মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী চুরি করার পর তার বিচার হবে না কেন? সবার বিচার হওয়ার দরকার। যাতে করে একটা দৃষ্টান্ত হতে পারে। তাহলে ভবিষ্যতে এ পদে কেউ আসলে চুরি করবে না।
লোক সংবাদ : আমাদের দেশের রাজনীতি তো দলীয় প্রভাবের ওপরই চলছে।
আ স ম রব : এই পার্টিসিজম সিস্টেম ডেমক্রেসি ‘পৃথিবীর কোথাও নেই। কেউ যদি আমাকে দেখাতে পারে আমি কালকে থেকে রাজনীতির ‘র’ ও মুখে আনবো না। ‘দিস সর্টস অব ব্লাডি স্টপিড’ সিস্টেম পৃথিবীর কোথাও নেই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে পাকিস্তানীদের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা দেশটাকে পেয়েছে এখন লুটেপুটে খাব, ভাগ-যোগ করে খাব। এখন আপনি কতটুকু নেবেন উনি কতটুকু নেবে, ইনি কতটুকু নেবেন এটা কম্প্রমাইজ করে। এখন এ রাজনীতি চলছে। আমাদের বর্তমান সিস্টেম যদি বিলীন না করা হয়, পুলিশ নেওয়ার সময় আওয়ামী লীগের পুলিশ, বিএনপির পুলিশ, এ চর্চা বন্ধ না হয় তাহলে আমাদের উন্নয়ন সহজ পথে কখনো হবে না। এই সিস্টেমে আমেরিকার মাফিয়া ফ্রি ইকোনমি কালচার চক্র পুরো দেশটাকে গ্রাস করে ফেলছে। এই পদ্ধতি অবশ্যই বিলীন করতে হবে।
লোক সংবাদ : নোয়াখালীর উপকূলে হাজার হাজার একর খাস জমি রয়েছে। অথচ ভূমিহীনরা সে জমি পাচেছ না। প্রভাবশালীরা চিংড়ী ঘেরের নামে জমি দখল করছে। এ বিষয়ে কিছু বলুন।
আ স ম রব : এ অঞ্চলে কোনো ভূমিহীন নাই। তাদের সবার বাড়িতে দোতলা টিনের ঘর ছিলো। এরা কেউ হাতিয়া থেকে, কেউ রামগতি থেকে নদী ভাঙনে এখানে এসেছে। বৃটিশ আমলে ছিলো বিশ বছর পর্যন্ত খাজনা দিলে জমি নদীর ভিতর থেকে উঠলে তার জমি সে পাবে। ‘বয়রা’ বলে এদেরকে। দুর্ভাগ্য হলো দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগ আমলে আইন করলো নদী ভাঙলে সে জমি খাস হবে। সরকার মালিক হয়ে যাবে। এটা কেমন কথা। আমি অনেক বলেছি একশ একরের মালিক তার জন্য সিলিং করে দিন। সে ত্রিশ বিঘার বেশি জমি রাখতে পারবে না। আজকে ডিসির কাছ থেকে একশ টাকার ফরম কিনতে হয় ভিে করে। আমার বেঁচে থাকার জন্য আমাকে জমি দেন। সত্যি এখানে কেউ কোনো দিন ভূমিহীন ছিলো না। তাদের বাপ দাদারা এলাকার সমৃদ্ধ মানুষ ছিলো। তাদেরকে প্রকৃতি ভূমিহীন করেছে।
লোক সংবাদ : নদীর পাড়ের মানুষের তো ভূমিহীন হওয়ার আশংকা রয়েছেই।
আ স ম রব : নদীর পাড়ের মানুষেরা বাড়ি করে বাড়ির চতুর্দিকে গড় বা খাল তৈরি করে, বাঁধ দেয়। জংলা বাদ দেয়। বাংলাদেশের মেঘনার মত এমন নদী দুনিয়ায় আর নেই। পৃথিবীর কোনো শক্তি নেই এই পাগলা মেঘনাকে বশ করে। একমাত্র দরকার ড্রেজিং করা। কোনো পাথর ঢেলে ভাঙন বন্ধ করা যাবে না। চাঁদপুরে যত পাথর ঢালা হয়েছে-যমুনাতে যত পাথর ঢালা হয়েছে সিরাগঞ্জ রার জন্য, এটা দিয়ে একশ টা সিরাজগঞ্জ তৈরি করা যেতো। এটা দিয়ে একশটা চাঁদপুর গড়া যেতো। আমরা নেদ্যারল্যান্ডের কাছে কেন যাব? নেদ্যারল্যান্ডের টেকনোলজিস্ট এসেছিল। কোস্টাল ডেভেলপমেন্টের জন্য। সে নদী দেখে বললো এটাকে নদী বলছ কেন? এটাতো সাগর। মিসিসিপির পরে মেঘনার যে মোহনা, এত বড় মোহনা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। বিষয়তো একটা নয়। ভূমিহীনদের কাছ থেকে জমি নিয়ে মাছের চাষ হচ্ছে। কিন্তু বন ধ্বংসের বিষয়টি কি হবে?
লোক সংবাদ : কিন্তু বন ধ্বংস যারা করছে, ঘের যারা তৈরি করছে তারা তো মতাধর, ধনী শ্রেণী।
আ স ম রব : এই যে গাছ কাটলো এই যে ঘের করলো- এটা ইন্টাররিলেটেড। ঢাকা শহরের সর্বোচ্চ স্থান পর্যন্ত এ টাকা যায়। এই টাকার শেয়ার কে পায় নাই। ঘেরের পারমিশন ডিসি দিয়েছে এডিসি দিয়েছে? সে কি ভাবে দিলো। আজ ভূমিহীনদের জমি বেদখল হচ্ছে। ভূমিহীনদের ঘর-বাড়ি পুড়ে দিচ্ছে। কাউকে মেরে ফেলছে, খুন করছে রেপ করছে। কেন ভূমিহীনদের কো-অপারেটিভ করা হচ্ছে না। কো-অপারেটিভ জমি হস্তান্তর করা যাবে না। ভূমি সংস্কার করতে হবে। আমি অনেক ভূমিহীনদের জমি দিয়েছি। সব বেহাত হয়ে গেছে। জোতদাররা নামে বেনামে কিনে নিয়েছে। সিস্টেম ইজ ডিফেকক্টিভ।
লোক সংবাদ : তাহলে আমরা এর বিকল্প পথ কি খুঁজতে পারি?
আ স ম রব : স্থানীয়ভাবে আমাদের সে পথ খুঁজতে হবে। নিজ এলাকার মানুষগুলোকে দিয়ে উন্নয়নের কাজ করতে হবে। স্থানীয়ভাবে সব করতে হবে। স্থানীয় লোককে স্থানীয় পাহারাদার নিয়োগ দিতে হবে। লোকাল গভর্নমেন্ট তাদের বাজেট করবে। পরিকল্পনা তারা করবে। একজন কৃষক খেত খামার বাড়ি-ঘরে পরিকল্পনা করে। সারা দেশের মানুষ আমাদেরকে খাওয়ায়। যারা উৎপাদন করে তারা না খেয়ে থাকে। আমরা যারা শহরে থাকি তারা ভোগ করি। এটাতো কোনো দুনিয়াতে নাই।
লোক সংবাদ : শহরের উপরতলার লোকরা ভূমিহীনদের জমি লুট করছে এটা কিভাবে রোধ করা যায়।
আ স ম রব : পারবেন না কিছু করতে।
লোক সংবাদ : এটা কি চলতে থাকবে?
আ স ম রব : যারা বাধা দিতে আসবে তারা মারা যাবে। কারণ ছয় কোটি টাকা দিয়ে নমিনেশন আনে আর ষোল কোটি টাকা যদি ইলেকশনে খরচ করে যদি মন্ত্রী হয়, যদি দুই চার ষোল জনকে মেরে ফেলে তবে বিশ কোটি দিয়ে জজ সাহেবকে কিনে ফেলবে। আপনি কিছুই করতে পারবেন না। দানবের কলিজা গুড়ো করে ফেলতে হবে। সিস্টেম চেইঞ্জ না করলে কিছু হবে না।
লোক সংবাদ : গ্রাম উন্নয়নের জন্য আমরা কিভাবে ভাবতে পারি? চরের মানুষকে কিভাবে কাজে লাগানো যায়?
আ স ম রব : গ্রামে দেখবেন একটি বাড়ি করতে তার চতুর্দিকে গড় বা খাল থাকতো। তার মধ্যে শিং মাছ, গজার মাছ, মাগুর মাছ, কৈ মাছ কিলবিল করতো। এ এলাকা থেকে চিংড়ি পোনা যারা কিনে নেয় তারা এদেরকে সারা দিনে দেয় পঞ্চাশ ষাট টাকা। অথচ একটি পোনা বিক্রি হয় দুই টাকা। এখানে যারা পোনা ধরে তারা অভাবের জন্য কাজ করে। আজ আমি দেখে আসলাম, সোনাপুরে চিংড়ি হ্যাচারিতে পঞ্চাশ থেকে ষাট লাখ পোনা উৎপাদন। সব খুলনা বাগেরহাট যাবে। এই যে টেকনোলজি, সরকারের একটাই কাজ টেকনজি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। তুমি বিরাট বিজ্ঞানী বইসা বইসা রুমের ভিতর বিরাট আবিষ্কার করছো, আমার কি আসে যায়- ‘ঘোড়ার ডিম’। তোমার বিজ্ঞানের বাস্তবায়ন করতে পারলে আমি ভাত খেতে পারবো কিনা সেটা দাও। সেটা দেবে না। দেওয়ার পদ্ধতি শিখাবে না, ভাল বীজ আসতে দিবে না। নতুন টেকনোলজির কথা মানুষ নামও শুনে নাই। এটা তো হয় না।
লোক সংবাদ : স্থানীয় সম্পদগুলোর কি হবে?
আ স ম রব : ইলিশ মাছ, মিষ্টি আলু, বাটা মাছ, কোরাল মাছ, পোয়া, ইছা, বাগদা, বাঘাতারা, মুগডাল, কলাই ডাল মরিচ, কাউন থেকে শুরু করে হাজার হাজার সম্পদ এখান থেকে চলে যাচ্ছে। দই যাচ্ছে, সাগর থেকে কোটি কোটি টাকার মাছ যাচ্ছে। কিন্তু আমার উন্নয়নের জন্য কী করছে? কেন্দ্রিয় সরকার যদি এই টাকার ৫০ শতাংশ স্থানীয় সরকারকে দেয় তাহলে স্থানীয়রা ঠিক করবে। তারা কিভাবে কি করবে।
চরের মানুষের বাঁচার জন্য তাদের আর কিছু নাই। সারভাইবের জন্য ওদের দরকার ল্যান্ড ওটা দিয়ে ধান্দা ও টিকে থাকতে চায়। ওটা করে চরের একটা ছাগলের জন্য মানুষ খুন করে। এখানে যে মানুষগুলো থাকে বছরের পর বছর অভাব অনটনে বেচে আছে। বর্ষা তিন মাস বৃষ্টির পানি খায়। এর পর লোনা পানি খাচ্ছে। পেট থেকে রক্ত যায়। আমাশয়, ডায়রিয়া লেগেই আছে। এটা তো হিউম্যান লাইফ নয়। সে বাধ্য হচ্ছে এখানে থাকতে। নো অলটারনেটিভ। কোনো বিকল্প নেই। নদীতে ভেঙ্গে গেছে। ঘর পড়ে গেছে? সরকার দেখে না? সরকার কি করছে। হেলিকপ্টারে যায় দেখে না। প্লেনে যায়-এটা দেখে না। হাজার হাজার একর বন বিরান করে ফেলছে। কে তা বন্ধ করবে। এটাতো গর্জিলার মত অবস্থা।
লোক সংবাদ : আইনের আশ্রয় কি নেয়া যায় না? প্রতিবাদ হচ্ছে না?
আ স ম রব : এর বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে গেলে চুরমার করে ফেলবে। মিথ্যা মামলা দিয়ে দেবে। এখানে থানা হলো বুশের ব্লাস্টার বোমার চেয়ে জঘন্য। কারণ কোনো ব্যাটাকে যদি জব্ধ করতে হয় তাহলে তার বিরুদ্ধে একটি মিথ্যা মামলা দিয়ে দাও। এবার বুঝুক, তার চৌদ্দগোষ্ঠী বৌ ছেলেমেয়ে জায়গা জমি বেচে ফকির হয়ে যাবে। আইনের লোকেরাও ঘুষ খায়-পাবলিকরা বলে। খবরের কাগজে লিখে। আমার কাছ থেকে না নিতে পারে-নিচ্ছে তো অনেকের কাছ থেকে। হাইকোর্ট কি কারণে এরশাদের সময় ডিসেন্ট্রালাইজেশন করতে দিলো না। কারণ ব্যারিস্ট্রার মওদুদ সাহেব, ইশতিয়াক সাহেবদের এটা মনোপলি ব্যবস্থা। ফ্রি ইকনমি কনসেপ্ট। ফ্রি ইকনমিতে গরিব আরো গরিব হবে। ভূমিহীন উচ্ছেদ হবে। থানা, কোর্ট, কাছারি সব আমার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আমি মাফিয়া আমার টাকা আছে। আমি সব কিনে ফেলবো। অসুবিধা কি? পলিটিশিয়ান নমিনেশন পায় না। টাকা দিয়ে ভোটে জিততে হবে। ভোট দিয়ে বাইরে এসে বলে আমরা কি করলাম। এরা তো পাঁচ বছরে পাঁচ হাজার মন গম বেচে ফেলবে। এই টাকার গণতন্ত্র নিষ্ফল।
লোক সংবাদ : আপনিতো রাজনীতি করছেন মানুষের জন্য।
আ স ম রব : আমি এখন কোনো রাজনীতি করি না। যে রাজনীতিতে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয় না সে রাজনীতি অর্থহীন। এখন যা চলছে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার চিন্তা তা ছিলো না।
লোক সংবাদ : এতণ সময় দেবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ
আ স ম রব : আপনাকেও ধন্যবাদ।

মাহমুদুল হক ফয়েজ


--Foez 10:06, 18 September 2010 (UTC)