বুদ্ধদেব বসুর নোয়াখালী

From WikiEducator
Jump to: navigation, search

বুদ্ধদেব বসুর নোয়াখালী

মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ


বুদ্ধদেব বসু, বাংলা সাহিত্যের এক অসাধারন প্রতিভা। তাঁর লেখায় প্রকৃতির প্রাণের স্পর্শে মোহিত হয়েছে পাঠক। গত শতাব্দীর বিশ ত্রিশ এর দশকে তাঁর শৈশব কৈশোর কেটেছে নোয়াখালীতে। শহর যখন প্রমত্ত মেঘনায় ভেঙ্গে যাচ্ছিলো তখন তাঁর স্মৃতিতে সে সব প্রথিত হয়ে গেছে স্বপ্নের মতন। পরবর্তীতে তাঁর জীবনের সমস্ত কাজে সে স্মৃতি হাতড়ে বেড়িয়েছেন। জীবনের কোনো সময় কখনো নোয়াখালীর সে স্মৃতিগুলো ভূলতে পারেননি। তাঁর স্মৃতিকথায তিনি লিখেছেন-

‘প্রথম চোখ ফুটলো নোয়াখালীতে। তার আগে অন্ধকার। আর তার সেই অন্ধকারে আলোর ফুলকি কয়েকটি মাত্র। সন্ধ্যা বেলায় চাঁদ উঠবার আগে উঠোন ভরে আল্পনা দিচ্ছেন বাড়ির বৃদ্ধা, মুগ্ধ হয়ে দেখছি। রাতের বিছানা দিনের বেলা পাহাড়ের ঢালুর মত করে ওল্টানো, তাতে ঠেসান দিয়ে পাতা উল্টাচ্ছি মস্ত বড় লাল মলাটের ‘বালক’ পত্রিকার। রোদ্দুর মাখা বিকেল টেনিস খেলা। একটি সুগোল মসৃন ধবধবে বল এসে লাগলো আমার পেরাম্বলেটরের চাকায়, বলটি আমি উপহার পেয়ে গেলুম। কিন্তু সে কোন দেশ কোন বছর, আজ পর্যন্ত আমি জানিনা। আমার জীবনের ধারাবাহিকতার সঙ্গে তাদের যোগ নেই। তারা যেন কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ছবি। আনেকআগে দেখা স্বপ্নের মতো। বছরের আবর্তনেও সে স্বপ্ন ভূলতে পারিনি। সচেতন জীবন অনবিচ্ছিন্ন ভাবে আরম্ভ হলো নোয়াখালীতে। প্রথম যে জনপদের নাম আমি জানলুম তা নোয়াখালী। নোয়াখালীর পথে এবং আপথে আমার ভূগোল শিক্ষা, আর সেখানেই এই প্রাথমিক ইতিহাস চেতনার বিকাশ যে- বছর বছর আমাদের বয়স বাড়ে। আমার কাছে নোয়াখালী মানেই ছেলেবেলা আর ছেলেবেলা মানেই নোয়াখালী’।

অনিন্দ সুন্দর সে শহরে ছিলো বাগবাগিচা আর ফলের রকমারি বাগান। গ্রীক পর্তুগীজ আরবীয় ইংরেজ সভ্যতার ছিলো এক মিশ্র ঐতিহ্য। সে ঐতিহ্যের সঙ্গে শিশুকাল থেকেই ছিলো তাঁর সখ্যতা।

‘আগের বাড়িটি একটি বৃহৎ ফল বাগানের মধ্যে। লোকে বলতো কেরুল সাহেবের বাগিচা। জানিনা কেরুল কোন পর্তুগীজ নামের অপভ্রংশ। ফলের এত প্রাচুর্য যে, মহিলারা ডাবের জল দিয়ে পা ধুতেন। খুব সবুজ, মনে পড়ে একটু অন্ধকার, কাছেই গীর্জা। সাদা-কোট পরা জমকালো লোকদের অনাত্মীয় লাগতো। গীর্জার ভিতরে গিয়েছি, ভিতরটা ছমছমে থমথমে। বাইরে সবুজ ঘাস, লম্বা ঝাউগাছ রোদ্দুর। বনবহুল ঘন সবুজ দেশ। সমুদ্র কাছে, মেঘনার রাক্ষুসী মোহনার ভীষন আলিঙ্গনে বাঁধা। সবচেয়ে সুন্দর রাস্তাটির দুদিকে ঝাউয়ের সারি। সেখানে সারাদিন গোল গোল আলো ছায়ার ঝিকিমিকি আর ঝাউয়ের ডালে দীর্ঘশ্বাস। সারাদিন সারারাত দলে দলে নারকেল গাছ উঠছে আকাশের দিকে; ছিপছিপে সখীদের পাশে পাশে। যেখানে সেখানে পুকুর, ডোবা নালা, গাবের আঠা, মাদারের কাঁটা, সাপের ভয়। শাদা ছোট ছোট দ্রোণ ফুলে প্রজাপতির আশাতিত ভীড়- আর কখনো সে ফুল আর কি একটা গাছে ছোট গোল কাঁটা ওয়ালা গুটি ধরতো। মজার খেলা ছিলো সেগুলি পরষ্পরের কাপড়ে জামায় ছুঁড়ে মারা। কি নাম তার ভূলে গেছি। হলদে লাল ম্যাজেন্টা গায়ে সারাটা শীত রঙ্গীন। এমন বাড়ি প্রায় ছিলোনা যার আঙ্গিনায় গুচ্ছ গুচ্ছ গাঁদা ধরে না থাকতো। শ্যমল সুঠাম এক একটি বাড়ি। বেড়া দেয়া বাগান নিকোনো উঠান, চোখ জুড়ানো খড়ের চাল, মাচার উপরে সবুজ উদ্গ্রীব লাউ কুমড়োর লতায় ফোঁটা ফোঁটা শিশির’।

অপূর্ব এক নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা ছিলো সে শহর। পথে পা বাড়ালেই ছিলো কাব্যের উপমা। প্রকৃতিতে থাকতো অপরুপ ব্যাঞ্জনা। তিনি হেঁটেছেন নোয়াখালীর পথে পথে, শহরের আনাচে কানাচে।

‘এমন কোনো পথ ছিলোনা নোয়াখালীর, যাতে হাঁটিনি। এমন মাঠ ছিলোনা যা মড়াইনি, দূরতম প্রান্ত থেকে প্রান্তে। শহর ছাড়িয়ে বনের কিনারে। নদীর এবড়ো থেবড়ো পাড়িতে, কালো কালো কাদায়, খোঁচা খোঁচা কাঁটায়, চোরাবালির বিপদে’।

সেকালে দক্ষিন বাংলার এক ব্যাস্ততম নৌবন্দর ছিলো শান্তাসীতা। সেটি এখন নতুন চর আর গ্রাম্যতার মিশেলে নবরুপে গড়ে উঠা এক পয়স্তি গ্রামীণ জনপদ। স্মৃতির কাব্যময়তায় এক রুপকথার নগরী। শুধূ কি রূপকথা ! যে বন্দরে একদিন দূর যাত্রার আগে বড় চাকার ষ্টিমার থেকে ভেঁপুর সকরুন সিম্ফনি বেজে যেতো। হাতিয়া, সন্দ্বীপ, চাঁদপুর, ঢাকা, কলকাতা বোম্বে, বার্মা আর ইউরোপীয় বন্দরের পথে পথে যাত্রা করতো যত্রীবাহী ষ্টিমার। সে সময়ের ক্ষয়িষ্ণু বন্দরের সে ঘাট থেকে তিনি অবলোকন করেছেন সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত। ডুব দিয়েছেন অপরূপ সে স্নিগ্ধ নৈ:সর্গে।

‘শান্তাসীতার নীলাভ রেখাটি যেখানে শেষ হয়েছে, দিগন্তের সে কুহক থেকে দেখা দিয়েছে আগুন রঙের সূর্য। প্রথমে কেঁপে কেঁপে তারপরে লম্বা লাফে উঠে গেছে আকাশে, দুরন্ত ঝলকে ঝলকে লাল করে দিয়ে। আবার সন্ধ্যাবেলা লাল সোনার খেলা পশ্চিমে’।

অপরূপ সে শহরকে গ্রাস করেছে রুদ্র রুক্ষ নদী। হারিয়ে গেছে কত স্মৃতি। সে রুক্ষতা প্রত্যক্ষ করে লিখলেন-

‘নোয়াখালীর সর্বস্ব ঐ নদীর কাছেই। নোয়াখালীর সর্বস্ব ঐ নদী নোয়াখালীর সর্বনাস’।

নোয়াখালীর ভাষার মধ্যে অন্যরকম এক সাতন্ত্রতা আছে, যা অন্য কোনো ভাষার মধ্যে বিরল। হাজার বছর ধরে এ জনপদের সাথে বিশ্বের নানান ভাষার সাথে যোগাযোগের সুবাদে এর ভাষাও হয়েছে অনেক সমৃদ্ধ। আঞ্চলিক ভাষার মাঝেও এত বৈচিত্র আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবেনা। এ অঞ্চলের ভাষার মাধুর্য পান্ডিত্য আর আসাধারণ ব্যায়াকরণ তাঁকে করেছিলো বিমুগ্ধ।

‘আর কোথাও শুনিনি ঐ ডাক, ঐ ভাষা, ঐ উচ্চারনের ভঙ্গি। বাংলার দক্ষিন-পূর্ব সীমান্তের ভাষা বৈশিষ্ট বিস্ময়কর। চাঁটগার যেটা খাঁটি ভাষা তাকেতো বাংলাই বলা যায়না। নোয়াখালীর ভাষা আমার মত জাত বাঙ্গালকেও কথায় কথায় চমকে দিতো। শুধু যে ক্রিয়াপদের প্রত্যয় অন্যরকম তা নয়, শুধু যে উচ্চারনের অর্ধস্ফুট ‘হ’ এর ছড়াছড়ি তাও নয়, নানা জিনিসের নামও শুনতাম আলাদা। সে সমস্ত কথায়ই মুসলমানী বলে মনে করতে পারিনা। অনেক তার মগ, কিছু হয়তো বর্মী আর পর্তুগীজের কোনো না ছিটে ফোটা। একে তো সমস্ত বাঙলাই পান্ডব বর্জিত, তার উপর বাংলার মধ্যেও অনার্যতর হোলো বাংলাদেশ। আবার সেই বাংলাদেশেও সবচেয়ে দূর, বিচ্ছিন্ন অশ্রুত এই নোয়াখালী’।

শহরের ঠিক সম্পূর্ণ ভাঙ্গন তিনি দেখননি। তার আগেই নোয়াখালী ছেড়ে চলে গেছেন। শহরের ভাঙ্গন যখন ঠিক মাঝামাঝি এলো তখন তিনি প্রকৃতির এক দুর্মদ রুক্ষতাকে প্রত্যক্ষ করলেন। দেখলেন শৈশবের দুরন্তপনায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়া জনপদ হারানোর কষ্টছোঁয়া হৃদয় দিয়ে।

‘দেখতে দেখতে কুঁকড়ে ছোট হয়ে গেলো নোয়াখালী। আমি শেষ দেখেছি, শহরের ঠিক মাঝ খানটিতে টাউন হলের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে- অমিতক্ষুধা জল। তারপর শুনেছি আরো ক্ষয়েছে। যে নোয়াখালী আমি দেখেছি, যাকে আমি বহন করেছি আমার মনে, আমার জীবনে, আমার স্মৃতিসত্তায়, আজ তার নাম মাত্রই হয়তো আছে, কিংবা কিছু নেই--কিছু নেই’।

সত্যি এখন সেই নোয়াখালীর কিছুই নেই। রাক্ষুসী সমুদ্রের ফেনিল ঢেউ আছড়ে পড়ে পড়ে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে গেছে বুদ্ধদেব বসুর সেই স্মৃতিময় প্রিয় নোয়াখালী। এখন আবার সেখানে জেগেছে চর। সমুদ্র চলে গেছে দূরে বহু দূরে। সেই উত্তাল সাগরের ভীষন গর্জন এখান থেকে আর শুনা যায়না। তাঁর হৃদয়ের শব্দে এখন কেউ কি শুনতে পায় সেই অপরূপ শহরের গান।

মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ
ফ্রীল্যান্স সাংবাদিক