ফিরিয়ে দাও সে অরণ্য

From WikiEducator
Jump to: navigation, search

ফিরিয়ে দাও সে অরণ্য
মাহমুদুল হক ফয়েজ

নির্বিচারে উজাড় হয়ে যাচ্ছে সবুজ বন। সভ্যতার ক্রান্তিলগ্নে গতিময় পৃথিবীর তাবৎ প্রাণিকুল আজ হুমকির সম্মুখীন। বিশ্বের পরিবেশবাদীরা সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। তারা বারবার আতঙ্কচিত্তে বলে যাচ্ছেন, বিপর্যয়ের মুখোমুখি এখন সমগ্র পরিবেশ। তাদের মতে এর মূল কারণ বায়ুমন্ডলে অত্যধিক কার্বন ডাই অক্সাইড বৃদ্ধি। এর ফলে কমে আসছে ওজন স্তরের ঘনত্ব। সৃষ্টি হচ্ছে পরিবেশ বিধ্বংসী গ্রীন হাউস এফেক্ট। এ পরিস্থিতিতে সচেতন মহলে গড়ে উঠছে পরিবেশ রার আন্দোলন।

পরিবেশ বিপর্যয়ে বাংলাদেশের কী কী তি হতে পারে, এ নিয়েও নানান আতংকবার্তা জানিয়েছেন পরিবেশবিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, গ্রীন হাউজ এফেক্টের কারণে বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা পানির নিচে নিমজ্জিত হতে পারে। ইতোমধ্যেই তার আলামত কিছুটা শুরু হয়েছে। প্রতি বছরই এখন অতিবন্যা প্রচন্ড খরায় আক্রান্ত হচ্ছে দেশ। পরিবর্তন হচ্ছে ঋতুচক্র, আশংকাজনকভাবে নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর, বৃদ্ধি পাচ্ছে ভূমন্ডলের তাপমাত্রা। এছাড়াও অপরাপর তিকর প্রভাবকে আলামত হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশে যোগ হয়েছে এক নতুন দুর্যোগ। পানিতে মরণ বিষ আর্সেনিকের মারাত্মক উপস্থিতি এবং নানান রাসায়নিক পদার্থের মাত্রাতিরিক্ত সম্পৃক্ততা ও সংমিশ্রণ ল করা যাচ্ছে। পরিবেশবিজ্ঞানীরা সব কিছুর জন্য নির্বিচারে বন উজাড়ের ঘটনাকেই মূলত দায়ী করছেন বার বার। এ নিয়ে পরীা নিরীাও চলেছে।

বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন সার্বিকভাবে পরিবেশের ভারসাম্য রার্থে প্রতিটি দেশের মোট আয়তনের অন্তত ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা অপরিহার্য। পঞ্চাশের দশকেও এ অঞ্চলে শতকরা ২৪ ভাগ বনভূমির অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু ক্রমেই মানুষজন বনভূমি ধ্বংস করে রু কঠিন মৃত্তিকার এক দেশে পরিণত করছে। বর্ধিত ফসল উৎপাদন, জনবসতির সম্প্রসারণ, নগরায়ন, শিল্প-কারখানার বিকাশসহ নানাবিধ কারণেই বনভূমি কেটে ফেলা হচ্ছে। উজাড় হচ্ছে বৃরাজি।

বর্তমানে বাংলাদেশে সবমিলিয়ে শতকরা ১৬ ভাগ বনভূমি আছে। এটি সরকারি হিসাব। পর্যবেক মহল মনে করেন বাস্তবে বনাঞ্চলের পরিমাণ ১০ থেকে ১২ ভাগের বেশি নয়। বেসরকারি হিসেবে অবশ্য বলা হয় দেশে এখন ৬.৫% বনভূমি রয়েছে। কোনো রকম অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা বনভূমির দিকে তাকালে পরিলতি হয় আরো করুণদশা। সংরণের অভাবে ঘন অরণ্যও আজ বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। সংঘবদ্ধ চক্র বনের গাছপালা উজাড় করেই ান্ত হয়নি জায়গা-জমি পর্যন্ত দখল করে নিয়েছে। পরিবেশ তিগ্রস্ত করার কারণে বিশ্বের বহু বিচিত্র প্রাণী ও পাখি হারিয়ে গেছে। বিজ্ঞানীদের পরিসংখ্যানে বিশ্বে ১ কোটি প্রজাতি উদ্ভিদ ও প্রাণী আছে। পূর্বে তার সংখ্যা আরো বেশি ছিল। গত এক দশকে পৃথিবীর নিরীয় বনাঞ্চলের পরিমাণ ১-৯০ কোটি হেক্টর থেকে নেমে ১-৭০ কোটি হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ প্রতিবছর পৃথিবী থেকে এক শতাংশ হারে বন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ভূমন্ডলের ট্রপিক্যাল ফরেস্ট ধ্বংস হওয়ার কারণে প্রতি মিনিটেই একটি করে জীব প্রজাতি লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বায়ুমন্ডলে বিভিন্ন গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ভূ-পৃষ্ঠের উত্তাপ গত ১০০ বছরে ০.৩০ ডিগ্রি থেকে ০.৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এর হার অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ভূ-পৃষ্ঠের গড় উত্তাপ ১ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উন্নীত হবে যা ভবিষ্যতে পৃথিবীতে মানুষের বসবাসের পে এক মারাত্মক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে। পরিবেশ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে পরিবেশ বিপর্যস্ত দেশ। সাধারণভাবে পরিবেশ ভারসাম্য রার্থে কোনো দেশের কমপে ২৫ শতাংশ বনভূমি দরকার। বাংলাদেশের মতো দেশে মোট কমপে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ থাকা বনভুমি অপরিহার্য। কিন্তু বর্তমানে আমাদের রয়েছে মাত্র ৬ শতাংশ বনভূমি। ১৯৭১ সালেও এই বনভূমি ১৭ শতাংশ ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে অব্যাহত লুটপাটের ফলে এটা বর্তমান পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। বর্তমানে দেশে মাথাপিছু বনভূমির পরিমাণ ০.০২২ হেক্টর যা বিশ্বের মধ্যে ভয়ানক রকমের সর্বনিু। এ বনভূমি আবার প্রতিবছর উজাড় হয়ে যাচ্ছে ৩.৩ শতাংশ হারে। সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রাম, শালবন, চকরিয়া, কক্সবাজার, ইত্যাদি বনাঞ্চল একে একে উজাড় হচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। ২০ হাজার একরের চকরিয়া বনভূমি শতকরা ১০০ ভাগ ধ্বংস হয়ে গেছে। সত্তরের দশকে শালবনের বনভূমি ছিল বিশ হাজার একর বর্তমানে তা হয়েছে মাত্র এক হাজার একর।

ষাটের দশক থেকে নোয়াখালীর দণি উপকূলে ঝড় জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলবাসীদের বাঁচানোর জন্য সৃষ্টি করা হয় উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী। সে সবুজ বেষ্টনী আজ প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। চর মজিদ, চর লক্ষ্মী, রামগতির এক ব্যাপক এলাকার বনভূমি উজাড় করে বসতি গড়ে উঠেছে। সবচেয়ে দুঃখজনক পরিস্থিতি হলো শহরে মতাধর ব্যক্তি, শিল্পপতিরা নির্বিচারে বন উজাড় করে চিংড়ি ঘের তৈরি করেছে। বন বিভাগের মামলা মোকদ্দমাও সে দখলদারিত্ব রোধ করতে পারেনি। বয়ার চরের ত্রিশ হাজার একরের বেশি বনাঞ্চল নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সেখানে কোনো দিন বন ছিল তাও এখন কেউ কল্পনা করতে পারবে না। এ দৃশ্য এখন সারা দেশ জুড়ে। রাবার বাগান ও ইউকেলিপটাস জাতীয় বিদেশি গাছ লাগানোর নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে হাজার বছরের রেইন ফরেস্ট ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে সুন্দরবন। দিনাজপুরের ঐতিহ্য শালবন স্বাধীনতার পরপর ধ্বংস হয়ে গেছে। যমুনা ব্রিজের জন্য ঢাকা টাঙ্গাইল সড়কের দুই পাশের অসংখ্য গাছ নির্বিচারে কেটে ফেলা হয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন নতুন সড়ক মহাসড়ক বানানোর জন্য বন উজাড় হচ্ছে। তেল গ্যাস উত্তোলনের জন্য ইজারা দেয়া হয়েছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে। তারা সারা দেশে অবাধে বৃ নিধন করছে। মাগুরছড়ার অগ্নিকান্ড সম্পর্কে আমরা জানি, কিভাবে বন ধ্বংস হলো প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস হলো। এভাবেই প্রতিনয়ত ধ্বংস হচ্ছে আমাদের পরিবেশ।

সারা দেশে বনায়ন, বন সংরণ ও সম্প্রসারণের দায়িত্বে আছে বন অধিদপ্তর। বিশাল সাংগঠনিক কাঠামো লোকবল আর আর্থিক সঙ্গতি নিয়েই তাদের কর্মকান্ড চলে। অথচ বন সংরণ ও সম্প্রসারিত করার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেই রয়েছে শত সহস্র অভিযোগ। এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারীকে কয়েক দশক ধরে বন বিভাগে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছে। নানা দুর্নীতি তাদের নিত্য সাথী। অভিযোগ রয়েছে নীতি নির্ধারণী শীর্ষ পদে আসীনদের অনেকেই দায়িত্ব পালনের েেত্র সীমাহীন ব্যর্থতা দেখিয়েছেন। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতীয় পত্র পত্রিকার প্রচুর লেখালেখি করা হয়েছে। আরো অভিযোগ রয়েছে বন ধ্বংসকারী বনদস্যুদের সাথে একশ্রেণীর অসাধু বন কর্মচারীদের রয়েছে গোপন সখ্যতা। নোয়াখালীর সমগ্র বয়ার চরে বন বিভাগ দৃষ্টিন্দন বন সৃজন করেছিলো। সে বন সম্পুর্ণ ধংস করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে এ বন ধ্বংস হয়েছে প্রশাসনের গাফিলতির কারণেই । প্রশাসন সচেষ্ট হলে বয়ার চরের বিশ হাজার একর বন রা করা সম্ভব হতো। বন বিভাগ জানিয়েছে, জনগণকে সম্পৃক্ত করে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি হিসেবে উপকূলীয় অঞ্চলে নিবিড় বনায়ন ব্যাপক সফলতা পেয়েছে। ১৯৮০ সাল থেকেই বন বিভাগ সম্পূর্ণভাবে জনগণের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরণের চমৎকার ও অনুপম বাগান সৃজন করে য়িষ্ণু বনাঞ্চল পুনর্বিন্যাস এবং বিপুল পরিমান প্রান্তিক ভূমিকে বন উৎপাদনের আওতায় আনা হয়। ইতোমধ্যেই সারা দেশে ৩০ হাজার ১৮৪ হেক্টর জমিতে উডলট, জ্বালানি কাঠের বাগান ও ব্লক বাগান সৃজন করা হয়েছে। কৃষি বন বাগান সৃজন করা হয়েছে ৬ হাজার ৯১৪ হেক্টর জমিতে। সড়ক পথ, রেলপথ, বাঁধ ও খালের পাড় মিলিয়ে মোট ৮২ হাজার ৭২২ কিলোমিটার ভূমিতে স্ট্রিপ বাগান তৈরি হয়েছে। গ্রাম বনায়ন হয়েছে ৭ হাজার ২৮২টি। এছাড়াও ৩ হাজার ৬শ ৬২টি ঝুমিয়া পরিবার পুনর্বাসিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠান, বসতবাটি ও অপরাপর প্রান্তিক ভূমিতে বনায়নের জন্য এ যাবত প্রায় ১৭ কোটি বৃচারা বিতরণ করা হয়েছে। তারা দাবি করেন উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী প্রকল্প বিস্ময়করভাবে সফলতা অর্জন করেছে। ২০০২ সাল পর্যন্ত ৯৮ শতাংশ সফলতা অর্জিত হয়েছে। বন ধ্বংস নয়। আগামী পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সবুজ বৃরে চর্চা ও লালন আজ সকলের জন্য একান্ত ভাবে প্রয়োজন।

মাহমুদুল হক ফয়েজ


--Foez 10:21, 18 September 2010 (UTC)