খাসজমির জটিলতা

From WikiEducator
Jump to: navigation, search

নোয়াখালীর উপকূলীয় খাস জমির জটিলতা-১


নোয়াখালীর উপকূলীয় খাস জমির জটিলতা-১

'মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ


নোয়াখালীর চরাঞ্চল সিকস্তি পয়স্তি ও খাসজমির জটিলতায় উত্তপ্ত

নোয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চলের ভৌগোলিক ইতিহাস ভাঙাগড়ার ইতিহাস। সিকস্তি পয়স্তির ইতিহাস পুরাতন ভূখণ্ড ভেঙ্গে যেমন এখানে নতুন নতুন চর জেগেছে, তেমনি আবার নদী বা সমুদ্র থেকে সম্পূর্ণ নতুন ভূখণ্ড জেগে উঠেছে। এই নতুন চর নিয়ে নোয়াখালী অঞ্চলে প্রতিনিয়ত চলছে মামলা, হামলা, দখল-পাল্টা দখল এবং রক্তয়ী সংঘর্ষ।

১৯৫০ সালে ভয়াবহ নদী ভাঙ্গনের ফলে নোয়াখালী সদর দপ্তর মাইজদীতে স্থানান্তরিত করার সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিল এবং প্রমাণপত্র হারিয়ে গেছে। এ দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে সুযোগসন্ধানীরা বিকল্প এবং কল্পিত দলিল তৈরি করে এতে সহায়তা করে সেটেলমেন্ট ও তহশিল অফিসের একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী। সিকস্তি পয়স্তি এবং দিয়ারা জরিপের হালনাগাদ এবং সঠিক তথ্য না পাওয়ায় নতুন চর দেখা দিলে অনেকেই সে জমির দাবীদার বনে যায়। অথচ জেগে ওঠা সব জমিই ‘পয়স্তি’ সম্পত্তি নয়। নতুন জেগে ওঠা চর ‘খাস জমি’ হিসেবে সরকারের পাওয়ার কথা, সরকার সাধারনত যেগুলো ভূমিহীনদের মাঝে বিতরন করে থাকে। পয়স্তি সম্পত্তি এবং খাসজমির গোলকধাঁধায় ঘুরছে নোয়াখালীর চরাঞ্চল।


সিকস্তি পয়স্তি কি?

বেঙ্গল রেগুলেশন অ্যাক্ট ১৮২৫ থেকে জানা যায়, কোনো ভূ-সম্পত্তি নদী বা সাগরে ভেঙ্গে বিলীন হয়ে গেলে তা ভূ-সম্পত্তির ভাঙন বা ‘সিকস্তি’ হিসাবে গণ্য হয়। অন্যদিকে, কোনো ভূ-সম্পত্তি নদী বা সাগরে বিলীন হওয়ার পর পুনরায় ‘পূর্বস্থানে’ জেগে উঠলে তা ‘পয়স্তি’ সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হয়। কিন্তু নদী বা সাগরে ‘নতুন’ জেগে ওঠা চর প্রচলিত আইনানুযায়ী ‘খাসজমি’ হিসেবে সরকারের ১নং খতিয়ানভুক্ত হয়।


এলাকা পরিচিতি

নোয়াখালী গেজেটের তথ্য অনুযায়ী বলা হয়েছে, বঙ্গপসাগরের মোহনায় নোয়াখালী জেলাটি একটি ব-দ্বীপ হিসেবে পরিচিত। নোয়াখালীর আদি নাম ছিল ভুলুয়া। ১৮২২ সালের ২৯ মার্চ ভুলুয়া পরগনার অধীনে এটি পত্তন হয়। প্রাক্তণ বাকেরগঞ্জ বা বরিশালের সঙ্গে ছিলো এর সংযুক্তি। দণি সাহবাজপুরও বলা হতো একে। কুমিল্লার সুধারাম, বেগমগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, বাকেরগঞ্জের দণি সাহবাজপুর ও উপকূলীয় অঞ্চল এবং চট্টগ্রামের হাতিয়া ও সন্দ্বীপ নিয়ে এটি গঠিত হয়েছিল। এর জেলা সদর স্থাপিত হয় নোয়াখালী মৌজায়।

১৯৫০-এর দশকে নোয়াখালী শহর সম্পূর্ণ নদীগর্ভে হারিয়ে গেলে বর্তমান মাইজদী কোর্টে এর সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে জেলা সদর মেঘনা নদীতে ভেঙ্গে আবার পত্তন হয়। বর্তমানে পুরাতন শহরটি একটি নতুন চরের নোয়াখালী ইউনিয়নের একটি মৌজা। যেখানে প্রাচীন শহরের চিহ্নটিও নেই।

১৯৮৪ সনে ফেনী ও লক্ষ্মীপুর জেলা গঠিত হলে নোয়াখালীর মধ্যে রাখা হয় ছয়টি থানা, সেগুলো হলো- চাটখিল, বেগমগঞ্জ, সেনবাগ, কোম্পানিগঞ্জ, হাতিয়া ও সদর। পুরো জেলাটি ৩ হাজার ৬ দশমিক ৯৯ বর্গ কিলোমিটার, তার মধ্যে ৮’শ ৬ দশমিক ৪৯ বর্গকিলোমিটার নদী এবং ৫’শ ৪৫ দশমিক ৬৬ বর্গকিলোমিটার সৃজিত বনভূমি। নোয়াখালী জেলা ২২.০৭ ও ২৩.০৮ উত্তর আংশ এবং ৯০.৫৩ ও ৯১.২৭ দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত।


সিকস্তি পয়স্তি মামলা

বৃটিশ আমল থেকে নোয়াখালী কোর্ট কাছারিতে সিকস্তি পয়স্তি সংক্রান্ত হাজার হাজার মামলা আজ অব্দি চলছে। প্রতিনিয়তই মামলার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। আদালত সূত্রে জানা গেছে ৪০/৫০ বছর ধরেও অনেক মামলা চলে আসছে। অনেকে কাগজপত্রের দুর্বলতার কারণে ন্যায্য বিচার পাচ্ছে না। এ বিষয়ে আদালতে যেমন চলে দুর্নীতি, আবার চলে তুঘলকী কাণ্ডও। মামলা পরিচালনার কারিশমাতে পড়ে একই মামলার রায় একবার বাদীর পক্ষেও যায় আবার বিবাদীর পক্ষেও যায়। মামলায় চলে সিকস্তি পয়স্তির সুক্ষ মারপ্যাঁচ। এ নিয়ে ভূমিগ্রাসীরা নিত্য নতুন ফন্দি ফিকির করতে থাকে।সবদিক ‘ম্যানেজ’ করে ভূয়া কাগজপত্র উপস্থাপন করে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারলেই মামলায় জেতা যায়। এরজন্য কূটবুদ্ধিসম্পন্ন মামলাবাজের অভাব নেই নোয়াখালীতে।


খাসজমি যেভাবে সিকস্তি করা হয়!

ভূমিহীনদের মাঝে বন্দবস্তকৃত খাসজমি আইনের ফাঁক গলিয়ে সিকস্তি পয়স্তি হিসেবে দখলের বহু নরিজ রয়েছে নোয়াখালী অঞ্চলে। ধরা যাক, সরকার ২০ জনকে এক বা দেড় একর করে জমি বন্দোবস্ত দিলো, কিন্তু দেখা যায় ছয় মাস কিংবা বছরের মাথায় শরিক একজন হয়ে যায়। ভূমিহীনরা কেউ সেখানে আর অবস্থান করেনা। এই যে একজন মালিক হয়ে যায়, অনেক ক্ষেত্রেই আইন পরোভাবে তাকে সহায়তা করে। এই ভূমিহীনরাও থাকে সাজানো। ভূমিহীনদের খাসজমি বন্টণের ক্ষেত্রে কবুলিয়তে শর্ত থাকে যে, এই সম্পত্তি হস্তান্তর করা যাবে না। কিন্তু তিনি সম্পত্তিটা বন্দোবস্তের পরপরই হস্তান্তর করে যান আর ফিরেও আসেন না। ভূমিগ্রাসী প্রভাবশালীরা বন্দোবস্তপ্রাপ্তদের কাছ থেকে জমি রেজিষ্ট্রির নাম করে কিছু টাকা দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। এতে অবশ্য ভূমিহীনরাও অখুশি নন, কারণ তারাতো কোনোদিনই এই জমিতে দখলে যেতে পারতো না। মাঝখান থেকে কিছু টাকা পেয়ে গেলো, মন্দ কি! পরবর্তীতে এই জমিগুলো জাল দলিল করে মামলার মাধ্যমে পূর্ব পুরুষের জমি অর্থাৎ চরে জেগে ওঠা পয়স্তি জমি হিসেবে দখল নয়া হয়। এরকম উদাহরণ নোয়াখালী অঞ্চলে অসংখ্য দেওয়া যেতে পারে। নিচের কেসস্টাডিতে এর প্রমাণ পাওয়া যাবে।


কেসস্টাডি:

একই মামলার দুই রায়


নোয়াখালীর দক্ষিণে ভাটিরটেক এলাকা যা পরবর্তীতে নবগ্রাম হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। বাংলাদেশ সরকার নবগ্রামকে পয়স্তি জরিপের মাধ্যমে ১৯৭৭-৭৮ সনে ঐ এলাকায় নতুন চর জেগে উঠলে ঐ নতুন জমি সরকার ভূমিহীনদের মাঝে বন্দোবস্ত দেয়। সেই মোতাবেক ভূমিহীনরা দেড়/দুই একর করে জমির মালিক হয়ে চাষাবাদ শুরু করে। ১৯৯৪ সনে জনৈক তফাজ্জল বারী নবগ্রামের ৯.৬০ একর বা ৮ কানী জমি তাঁর নিজের মালিকানা বলে দাবী করে আদালতে মামলা করেন। আদালতে তিনি ৮ জন ভূমিহীনদের বদলে বাংলাদেশ সরকারকে বিবাদী করে মামলা দায়ের করেন। তিনি ঐ জমির স্থাবর সম্পত্তিতে রায়তি স্বত্ব ঘোষণার জন্য মামলায় আর্জি পেশ করেন। মামলা নং দেং ৩৬০/১৯৯৪, ৩ জন বিবাদী হলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পে (১) ডেপুটি কমিশনার (২) অতি: জেলা প্রশাসক(রাজস্ব) এবং (৩) সহকারী কমিশনার(ভূমি), সদর নোয়াখালী।

তফাজ্জল বারী দাবী করেন ৫ নং তৌজিভুক্ত পরগনে ভূলুয়া পরগনার জমিদারী অন্তর্গত জগদানন্দ মৌজায় চিরিঙ্গা কিসমত মহল খোদ কাসাদার বিনয় কয়েমী পওনী তালুক শ্রী গোলক চন্দ্র রায় চৌধুরী বিগত ১৮৯৯ সনে নোয়াখালী জজ আদালতের ৩ নং দেওয়ানী মোকদ্দমার ডিক্রি প্রাপ্ত হয়ে শ্রীযুক্ত বাবু গোলক চন্দ্র রায় চৌধুরী পিতা মৃত শ্রী মোহন চাঁদ রায় চৌধুরী ও শ্রীযুক্ত ঈশ্বর চন্দ্র রায় চৌধুরী ও শ্রীযুক্ত যশোদা কুমার রায় চৌধুরী পিতা মৃত কৃষ্ণ চন্দ্র রায় চৌধুরী উক্ত জমির মালিক ও দখলদার হয় এবং ছিলো। অধিগ্রহণসূত্রে বর্তমান মালিক বাংলাদেশ সরকার।

শ্রীযুক্ত বাবু গোলক চন্দ্র রায় চৌধুরী গং দখলদার থাকা অবস্থায় জিলা জরিপ চলার পূর্বে সমুদয় তালুকের ভূমি নদী সিকস্তি হওয়ায় তালুকের সমুদয় ভূমি জিলা জরিপ বহির্ভূত থাকে। ৯/১০ বছর পর পূন:পয়স্তি হলে উল্লেখিত মালিকগণ তাদের তালুকের ভূমি পরিচিহ্নিত করার জন্য ১৮৯৯ সনের ৩ নং দেওয়ানী মোকদ্দমার সিভিল কোর্ট কমিশনারের প্রস্তুতকৃত নকশার ভিত্তিতে পরিমাণ ও পরিচিহ্নিত করে সীমানা চৌহদ্দী ঠিক করে।

পরবর্তী সময়ে প্রজাপত্তনি ও চাষাবাদের সুবিধার জন্য বিগত ১৯৪৪ ইং সনে ওই স্টেটের নিযুক্ত আমিনদ্বারা সরেজমিনে পরিমাপ করিয়ে পুন: নকশা প্রস্তুত করানো হয়। উক্ত নকশা প্রস্তুতের পর তালুকের বহু ভূমি অনাবাদী থাকায় তা আবাদ করার জন্য বিনা সেলামীতে আবাদকারীদের নিজ জিম্মায় দুই বছরের জন্য ইজারা দেয়া হয়। ১৩৫১ বাংলা সনের ১০ চৈত্র মালিক শ্রীযুক্ত বাবু গোলক চন্দ্র রায় চৌধুরী গং লিখিত ও সম্পাদিত হুকুমনামা মূলে বাদী তফাজ্জল বারী চাষাবাদের অনুমতি গ্রহণ করেন। উক্ত ভূমিটি জরিপীয় নকশার ২৮/১ দাগের অন্দরে ১১৭ ও ১১৮ দুইটি দাগে মোট ৮ কানী বা ৯ দশমিক ৬০ ডিং। বাদী দাবী করছে সেই থেকে উক্ত জমিটি বাদীর ভোগদখলে ছিলো এবং আছে।

মামলায় বাদী অভিযোগ করে যে সরকারের তহশিল কর্মচারীগণ জরিপ বিভাগের কর্মচারীদের ভুল বুঝানোর মাধ্যমে বাদীর অগোচরে ও অসাাতে অন্যায় ও বেআইনিভাবে বাদীর নামের মাঠ খতিয়ান কর্তন করে সরকারের ১ নং খাস খতিয়ানে রেকর্ডভুক্ত করে। বাদী উক্ত মামলায় তহসিল অফিসের কারসাজি ও তঞ্চক বলে দাবী করেন এবং উক্ত ৮ কানী বা ৯.৬০ একর জমি আইনি ফেরত পাবার জন্য আবেদন করেন।

অপরদিকে সরকারে পে বলা হয় উক্ত নালিশী ভূমি ৬০/৭০ বছর নদী গর্ভে বিলীন ছিলো। উক্ত নালিশী ভূমিতে মামলার বাদী’র কখনো দখল ছিলো না। নালিশী ভূমি বাদীকে বন্দোবস্ত দেওয়া এবং তাঁর দখলদার থাকার উক্তি সত্য নয়। দীর্ঘদিন যাবত নালিশী ভূমি নদীগর্ভে থাকার পর সরকার কর্তৃক নোয়াখালী উপকূলীয় এলাকায় নদীর গতিবিধি ও বন্যার তোড় নিবারনার্থে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ করে। এর ফলে নদীর গতিশক্তি স্তিমিত হয়ে নতুন ভূমি জেগে উঠলে অর্থাৎ পয়স্তি হলে ১৯৭৭-৭৮ ইং সনে সরকার কর্তৃক জরিপ সম্পূর্ণ হয়। যা ২৯৬ নং নবগ্রাম মৌজা নামকরণ করে নালিশী ভূমিকে সরকারের ১ নং খাস খতিয়ানে রেকর্ডভুক্ত করে। অন্য কোনো ব্যক্তির নামে নালিশী ভূমি রেকর্ড হয়নি। এরপর খাস জমি বন্দোবস্ত নীতির আওতায় ১৯৮৯-৯০ ইং সনে ওই জমি ৮ জন ভূমিহীনকে বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে। বন্দোবস্তকারীগণ উক্ত ভূমিতে বাড়িঘর নির্মাণ ও চাষাবাদ করে ভোগ দখল করে আসছে। সরকার প দাবী করেন উক্ত জমিটি সম্পূর্ণ নতুন জমি এবং বাদী তফাজ্জল বারীর কোনো স্বত্ব নেই।

বিভিন্ন দলিল কবুলিয়ত পর্যালোচনা করে এবং স্বাক্ষীদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞ আদালত ১ নং অতিরিক্ত সদর আদালতের সহকারী জজ মামুনুর রশিদ ২৮-৬-৯৯ তারিখের বিচারের রায়ে উক্ত মামলাটি খারিজের আদেশ দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে ৫-৭-৯৯ সনে আদালতে আপিল দায়ের করা হয়। মামলাটি পুন:বিচারের জন্য আদালতেসকল প্রমানাদি নতুন করে গ্রহণ করা হয়।


কিন্তু বিজ্ঞ আদালত বাদী তফাজ্জল বারীর পক্ষে রায় প্রদান করেন। এই বারও রায় প্রদান করেন বিজ্ঞ আদালত ১ নং অতিরিক্ত সদর আদালতের সহকারী জজ মামুনুর রশিদ। রায়ে বলা হয়, বাদীর পক্ষে আনীত অত্র দেওয়ানী ৩৬০/১৯৯৪ নং মোকদ্দমাটিতে প্রতিদ্বন্দ্বীতাকারী ১ হতে ৩ বিবাদী পরে বিরুদ্ধে দোতরফা সূত্রে বিনা খরচে ডিক্রি দেওয়া গেল। একই সঙ্গে ২৯৬ নং নবগ্রাম মৌজার দিয়ারা জরিপ ১ নং খতিয়ানের ১২২ দাগে ৫.৯২ একর অন্দরে উত্তর অংশে ৫.০০ একর ভুমিতে এবং ১২১ দাগে ৮.০০ একর অন্দরে দক্ষিণ অংশে ৪.৬০ একর একুনে ৯.৬০ একর ভূমিতে বাদী পরে অনুকূলে রায়তি স্বত্ব ঘোষণা করা গেলো।

বাদীর পক্ষে রায় হওয়াতে ওই ভূমি থেকে সরকার প্রদত্ত বন্দোবস্ত পাওয়া ভূমিহীনরা উচ্ছেদ হয়ে গেলো। কিন্তু ওই ভূমিহীনরা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এর বিরুদ্ধে কোনো আপত্তি করে নি। প্রশ্ন উদ্ভব হয়, ওই ভূমিতে কি কোনো ভূমিহীন আদৌ ছিলো? বা থেকে থাকলে কারা? না কি পুরো বন্দোবস্ত প্রক্রিয়াতেই কোনো গলদ ছিলো, যা পরবর্তীতে আইনের মাধ্যমে নিষ্কন্টক করা হলো? এই মামলায় দেখা যায় নবগ্রাম মৌজাটি একসময় ভুলুয়া জমিদারীর অধীনে ঘন বসতিপূর্ণ অঞ্চল ছিলো। প্রায় শত বছর পূর্বে এ অঞ্চলটি একটি মূল ভূখন্ড ছিলো। ১৯৭২ সনের সিকস্তি পয়স্তি আইনে কোনো জমি সিকস্তি হয়ে আবার পয়স্তি হলে তা সরকারি ১ নং খাস খতিয়ানে চলে যাবে এবং সরকার সে জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণ করবে। কিন্তু ১৯৭২ সনের সিকস্তি পয়স্তি আইন সংশোধন করা হলে ভূমিগ্রাসী ও সুযোগ সন্ধানীরা ব্যাপক সুযোগ পেয়ে যায়। আইনের ফাঁক গলিয়ে অনেক ভূয়া ও বানানো দলিল কোর্টে গ্রহণ করা হচ্ছে। তা ছাড়া সেটেলমেন্ট ও তহশিল অফিসের একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এ কাজে সক্রিয়ভাবে জড়িত রয়েছে।


সেটেলমেন্ট অফিস এবং জরিপ বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করছে প্রভাবশালীরা

সরকারি জরিপ বিভাগের দায়িত্ব কোনো জায়গায় কতটুকু জমি কোন সময়ে ভেঙ্গে গেছে কিংবা জেগে উঠেছে অর্থাৎ শিকস্তি পয়স্তি জরিপ সার্বক্ষণিক করার বিধান আছে। দিয়ারা জরিপ সবসময়ই চলার কথা। কিন্তু নানান কারণে নোয়াখালীতে এর সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। জোতদার ভূমিগ্রাসীরা এটিকে পূর্ণাঙ্গভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। এক সময় যা খাসমহল ছিলো সেই কাগজপত্রগুলো কিংবা কেএম খতিয়ানগুলো পাওয়া যায় না। বালামের পাতাই থাকে না কিংবা ছিঁড়ে ফেলে দেয়া হয়। বালাম বইয়ের পাতা ছেঁড়া হচ্ছে, কিন্তু এর জন্য কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে না।

যেখানে জমি উঠছে সেখানে একদল জোতদার বলছে এখানে তার চৌদ্দপুরুষের জায়গা ছিলো। এ সংক্রান্ত কাগজও তৈরি করা হয়ে যায়। আবার এ সংক্রান্ত স্বাক্ষ্য আইনেরও জটিলতা আছে। এ সংক্রান্ত আইনে ত্রিশ বছর পূর্বের কাগজও কোর্টে গ্রহণ হচ্ছে। ধরা যাক জমিদারী আমলের একটি দলিল, হুকুমনামা বা কবুলিয়ত আমি বানিয়ে নিলাম, যাচাই বাছাই করার প্রক্রিয়াও নেই। সেটিকে আদালত মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। আইনের দুর্বলতা কিংবা আইনের ফাঁক ফোকর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ব্যবহার করছে ভুমিগ্রাসী প্রভাবশালীরা।

অ্যাডভোকেট ফজলে আজিম ১৯৯৫ সন থেকে নোয়াখালী দেওয়ানী আদালতে অসংখ্য সিকস্তি পয়স্তি মামলা পরিচালনা করেছেন। তিনি জানান, যখন কোনো জমি নদীতে ভেঙ্গে আবার চর দেখা দেয় তখন জমির মালিকরা উঠে পড়ে লাগে। কেউ কেউ ছল চাতুরীর আশ্রয় নেয়। অনেকেই মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে যায়। সিকস্তি পয়স্তির ফলে জমি চিহ্নিতকরণ একটি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। দেখা যায় যে একই জমি দুই জন দাবী করে বসে। মাপের ক্ষেত্রে সীমানা পিলার থেকেই জরিপ করে মাপ দেয়ার নিয়ম। কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রে সীমানা পিলার পাওয়া যায় না। তখন কোর্টের মাধ্যমে সরেজমিন তদন্ত করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যে ক্ষেত্রে সাবেক পেটিসার্ভ ও ১৯৬০-১৯৬৫ সনের পরিচালিত এস এ সার্ভে তুলনামূলক হিসাব করে সঠিক অবস্থান নির্ণয় করার বিধান রয়েছে। সীমানা পিলার জটিলতায় অনেক মামলা দীর্ঘদিন ধরে আদালতে আটকে আছে। নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণে মানুষের ভোগান্তিও বেড়ে যায়।

মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

ম্যস লাইন মিডিয়া সেন্টার(এম এমসি) কতৃক ফেলোশিপের আওতায় এই রিপোর্টগুলো তৈরী করা হয়েছে।

Foez 06:15, 13 January 2010 (UTC)